প্রাতে নিদ্রাভঙ্গ হইলে আশালতা কর্ণকুহরে শ্রবণ যন্ত্রটি প্রবিষ্ট করিয়া চলমান দূরভাষটিতে সংযোগ স্থাপন করিল। সম্প্রতি দূরদর্শণের একটি ধারাবাহিক তাহার সমগ্র মনোযোগ আকৃষ্ট করিয়া লইয়াছে। ‘খড়কুটো’ নাম্নী ধারাবাহিকটির নূতন নূতন পর্ব আগাম অন্তর্জালের মধ্য দিয়া জ্ঞাত হইলে ভবিষ্যৎ দ্রষ্টার ন্যায় অদ্ভুত এক প্রশান্তি অনুভূত হয়। এক্ষণে ধারাবাহিকটিতে প্রবল হাস্যকর দৃশ্যাবলী সৃষ্টি হইবার নিমিত্ত আশালতা তাহার হাস্য চাপিয়া রাখিতে প্রাণপণ সচেষ্ট হইলেও ব্যর্থ হইল। তাহার অন্তস্থল হইতে প্রবল অট্টহাস্য ভুরভুড়ি কাটিয়া বাহির হইয়া আসিয়া তাহাকে নিতান্তই আতান্তরে ফেলিল। বর্তমানে তাহার পুত্র হস্ত এবং পদে মস্তক চাড়া দিয়া উঠিয়াছে। কৈশোরপ্রাপ্তির দোরগোড়ায় উপস্থিত হইলেও হাবেভাবে অদ্যবধি শিশুই। অপ্রতুল শয্যাখানিতে আশালতা এবং তাহার স্বামী দুই প্রান্তে জড়সড় হইয়া থাকে। পুত্রটি তাহাদের মধ্যবর্তী স্থান আলোকিত করিয়া নিদ্রা যায়। পূর্বে এইরূপ প্রভাতকালে শিশুপুত্রটিকে পার্শ্বে সরাইয়া রাখিয়া স্বামীকে উপাধান অবলম্বনে জড়াইয়া শুইতো। অনেককাল হইয়াছে এই অভ্যাসটি তাহাকে ছাড়িয়া গিয়াছে। এক্ষণে চক্ষু উম্মিলিত করিয়াই সে দূরভাষটিকে মুষ্টিবদ্ধ করিয়া মুখপুস্তিকাটি খুলিয়া নিতান্ত বাধ্য ছাত্রীর ন্যায় অধ্যাবসায় আরম্ভ করিল। বর্তমান ইহাই তাহার রেজিম। এক্ষণে ‘খড়কুটো’ নাম্নী ধারাবাহিকটি সংযুক্ত হইয়াছে।
প্রাতঃ চৌত্রিশ গতে পঞ্চম ঘটিকা হইয়াছে। আশালতার স্বামী প্রচন্ড মুখব্যদন করিয়া ঘুমাইতেছিল। তাহার নাসারন্ধ্র হইতে বজ্রপাতসম শব্দরাজি বর্ষিত হইতেছিল। আশালতার প্রচন্ড অট্টহাস্যে তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। স্বামীটি চিরকালই আলালের গৃহে দুলালসর্বস্ব। যেমন সচরাচর সকল প্রকার স্বামীই হইয়া থাকেন। এক্ষণে কাঁচা নিদ্রাভঙ্গ হইতে সে যারপরনাই বিরক্তি প্রকাশ করিল। প্রচন্ড মুখভঙ্গি করিয়া সে পার্শ্বে ফিরিয়া পুনরায় শুইয়া পড়িল।
বেচারা আশালতা ধারাবাহিকের নায়কের স্থলে স্বামীকে এবং নায়িকার স্থলে আপনাকে আসীন করাইয়া অত্যন্ত পুলকিত ছিল। এক্ষণে কঠোর বাস্তবের আঘাতে তাহার ধ্যান ভঙ্গ হইল। বাহিরে তখন প্রভাত সূর্যের উদয় হইয়াছে। মৃদুমন্দ বাতাস বহিতেছে। গবাক্ষের বাহিরে একটি রক্তপলাশ বৃক্ষে অনবরত একাকী কোকিল কুহুরবে তাহার সঙ্গিনীকে আহ্বান করিতেছে। ক্রমে কুহুতান আশালতার নিকট অসহ্য বোধ হইতে লাগিল। সে আরশির সম্মুখে দাঁড়াইল। আরশির মানুষটিকে সহসা পরিচিত বোধ হইল না। চক্ষুর প্রান্তভাগে পক্ষীর আঁচড় পরিলক্ষিত হইল। কর্ণের উপরিভাগে ছয় সাতটি পক্ককেশ দেখিয়া হৃদয় ভারাক্রান্ত হইল। লৌহ চিমটাটি লইয়া সে
ততক্ষনাৎ পক্ককেশগুলি উৎপাটিত করিতে উদ্যত হইল। স্বামীটিকে একটি কিম্ভুতকিমাকার জীব বলিয়া মনে হইতে লাগিল। এক্ষণে বসন্ত আসিয়াছে। তথাপি কেবলই মনে হইতে লাগিল তাহার জীবনে প্রবল শৈত্য। শুষ্ক পত্রসকল ঝরিবার সময় প্রবলভাবে আসন পাতিয়া বসিয়া রহিয়াছে। সহসাই সে আবিষ্কার করিল বসন্ত তাহাদের মধ্যে মধ্যপদলোপী কর্মধারয় ব্যতিরেকে কিচ্ছুটি নয়।
স্বামীটি আপিসে বাহির হইয়া যাইলে রাঁধাবাড়া করিয়া পুত্রকে খাওয়াইয়া দ্বিপ্রহরে সে নিকটবর্তী ‘ভেনাস’ নামক রূপরঞ্জক পার্লারটিতে গিয়া উপস্থিত হইল। ঘন্টাখানেক ধরিয়া অক্সিজেন মাত্রা এবংবিধ পর্যবেক্ষণ করিয়া ও আপাদমস্তক বিশুদ্ধিকরণবাষ্প দিয়া ধৌত করিবার পর পার্লার কর্তৃপক্ষ তাহাকে প্রবেশ করিতে অনুমতি দিল। পার্লারস্বামিনীর মাধ্যমে জ্ঞাত হইল যে নূতনপ্রকার কি একটি মুখমার্জনার ক্রীম আসিয়াছে। উহা মাখিলেই নাকি ত্বকের কুঞ্চন বন্ধ হইয়া পূর্বের জেল্লা ফিরিয়া আসে। আশালতা সম্মতি দিয়া আসনে উপবিষ্ট হইল। পেলব হস্ত লইয়া একটি কোমলমতি বালিকা আসিয়া তাহার মুখখানি ধৌত করিয়া দিল। তাহারপর উপর্যুপরি মুখখানিতে একটির পর একটি সুগন্ধী প্রলেপ লাগাইয়া দিয়া মালিশ করিতে লাগিল। প্রচন্ড আরামে তাহার চক্ষু মুদিত হইয়া আসিল। বালিকাটি তখন তাহাকে প্রস্তাব দিল,
—“মা জননী, আপনার গাত্র মার্জনা করিয়া দিব?”
— “দিস।”
— “হিয়া শেঠের কেশরঞ্জনী দিয়া কেশ রঞ্জিত করিয়া দিব মা?”
ছোট্ট একটি শ্বাস চাপিয়া আশালতা কহিল, “দিস।”
—- “আপনার কেশ অতীব রুক্ষ। হস্ত এবং পদও। এরও নিরাময় আছে। হস্ত, পদ ও নাসিকার নিম্নের রোমসকল উৎপাটিত করিয়া স্পা করিয়া দিব।”
এতকথা আশালতার শ্রবনেন্দ্রিয়ে অনুভূত হইল না। নিদ্রাদেবী তাহার দুই চক্ষে ভর করিয়াছে। কোনপ্রকারে মস্তক হেলাইয়া সম্মতি জানাইল সে।
এইরূপে চারি ঘন্টা অতিক্রান্ত হইলে তাহার নিদ্রাভঙ্গ হইল। ইতিমধ্যে গাত্র মর্দন ও অন্যান্য সকলপ্রকার সৌন্দর্যবর্ধক প্রক্রিয়া সমাপ্ত হইয়াছে। পার্লারস্বামিনী তাহার হস্তে একটি বৃহদাকার ভূর্জপত্রের ন্যায় রসিদ ধরাইয়া দিল। অতি উৎসাহে তাহার সহিত একখানি ছবি তুলিয়া তৎক্ষনাৎ মুখপুস্তিকায় প্রকাশ করিয়া “অন্য বসন্ত” ক্যাপশানিত করিয়া উহাকে ট্যাগাইয়া দিল।
আশালতা যারপরনাই আনন্দিত হইয়া বটুয়া হইতে কর্জ করিবার কার্ডটি বাহির করিয়া রসিদ মিটাইয়া দিল।
গৃহাভিমুখে গমন করিতে করিতে বসন্ত পবনে মুখপুস্তিকা হাতড়াইয়া দেখিল তাহার ছবিটিতে ইতিমধ্যে পছন্দ ও মন্তব্যের সংখ্যা দুই শত ছাড়াইয়াছে।
মৃদু হাসিয়া আশালতা মনে মনে বলিল,
“এক্ষণে বসন্ত আসিয়াছে। বসন্ত কর্জ করিয়া ক্রয় করিয়া আনিয়াছি।”
★★★
#পাখী