গত বছর থেকে অতিমারির কারণে বাঙালির সব রকম উৎসবে ভাঁটা পড়েছে। তবু যখন বর্ষাশেষে ঘন নীল আকাশে জল ভারহীন লঘুমেঘের দল ডানা মেলে, রোদ্দুরে সোনা রঙ লাগে, বাতাসে হিমেল পরশ, আঙিনা আলো করে ঝরে পড়ে অজস্র শিউলি। পতিত জমিতে, নদীতীরে, জমির আলে দলে দলে কাশ মাথা দোলায়, দিঘি পুকুর আলো হয়ে থাকে শালুক-পদ্মে, তখন পাটপচানির গন্ধও ভারি মিঠে লাগে। গেরস্থের দুয়ারে দুয়ারে আগমনী গেয়ে চলে গ্রামীন শিল্পী। মা আসছেন। চাই কী আকাশ জুড়ে রামধনুও বড় উজ্জ্বল হয় তখন।
এই সময়েই জগজ্জননী মা দুর্গা ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন পাঁচটি দিনের জন্য। আপামর বাঙালি, দরিদ্র বাঙালি, ঘরকুনো বাঙালি, গেরস্থ বাঙালি, মহাজনি দেনার দায়ে আধপেটা খাওয়া জর্জরিত হাড্ডিসার বাঙালি, ভাগচাষী বাঙালির হৃদকমলে ঢেউ জাগে। প্রবাসী বাঙালি ঘরে ফেরে। বেশ অন্যরকম লাগে সময়টা। শতেক দুঃখ দারিদ্রের মধ্যেও চারপাশটা আলো আলো হয়ে ওঠে।
বারোয়ারি তলার চণ্ডীমণ্ডপে কাঠামো বাঁধা শুরু হয়ে গেছে। কাঠামোর গায়ে খড় জড়ানো, মাটি লাগানো হচ্ছে। ঠাকুর একমেটে হলো, দোমেটে হলো। সারি সারি ছাঁচের মুখ আকাশপানে ভাদ্রের রোদ্দুরে শুকোচ্ছে চটের ওপর। ঢাকিপাড়ায় ঢাক ছাইবার তোড়জোড়। বিকেল হলে ঢাকের মহড়া শোনা যাচ্ছে। অমুক জায়গায় যাত্রার আসর বসবে, অমুক জায়গায় পুতুলনাচের বায়না হয়েছে…এসবও কানে আসছে। আমরা ছোটরা স্কুলে আসাযাওয়ার পথে ঠাকুর গড়া দেখছি কিছুটা সময় ধরে। যাত্রা আর পুতুলনাচের খবর পৌঁছে দিচ্ছি বাড়ির অন্দরমহলে। এসব হলো গাঁ গঞ্জের কথা। কিন্তু কলকাতায় বা আমাদের রাজ্যে বা অন্য কোথাও?
হিন্দুপ্রধান কলকাতারও বড় উৎসব তো দুর্গাপুজোই। উত্তর গোলার্ধের রিও কার্নিভ্যাল বলা হয় কলকাতার দুর্গাপুজোকে। পুজোর মাস কয়েক আগে থেকে যে ভিড়ভাড়াট্টা দেখা যেত রাস্তাঘাটে, কেনাকাটার হিড়িক লাগত দোকানে দোকানে ,গত বছরের মত এবছরও তা দেখা যাচ্ছে না এখনো। এই অবস্থায় ঘরে বসে স্মৃতিচারণ করা ছাড়া আর উপায় কী!
অজয় নদীর তীরে বসন্তকালে দুর্গাপুজো করে সুরথ রাজা সম্পত্তি উদ্ধার করলেন, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেন তিনি। রামচন্দ্র শরতকালে অকালবোধন করে সীতা উদ্ধার করলেন। বউ পাগল বাঙালি শরতকালকেই বেছে নিল মাতৃ আরাধনার জন্য। অকালবোধনই হয়ে উঠল আমাদের বড় উৎসব।
অকালবোধন কেন? হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে শরতকাল হল দেবদেবীদের ঘুমোবার সময়। এ সময় তাঁদের জাগাতে নেই। বিপাকে পড়ে রামচন্দ্রকে অকালবোধন করতে হয়েছিল। অবশ্য বাল্মিকী রচিত মূল রামায়ণে এটি নেই। কেউ কেউ বলেন বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ হলো অকালবোধন।
জনশ্রুতি আছে রাজশাহীর তাহিরপুরে রাজা কংসনারায়ণ মহা আড়ম্বরের সঙ্গে প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা করেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মহালয়ার দিন থেকে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। মহালয়া থেকে যজ্ঞ শুরু হতো তাঁর পুজোয়। যজ্ঞের আগুন নিভতো না ক-দিন। দেবী এখানে যোদ্ধৃবেশে। প্রতিমা তৈরির মাটি মাখা হতো শুধুমাত্র গঙ্গাজল দিয়ে। সেজন্য নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাট থেকে গঙ্গাজল আনা হতো। ভাসানে নীলকণ্ঠ পাখি সঙ্গে যেত। ভাসান হয়ে গেলে পাখি ফিরত রাজবাড়ীতে। নীলকণ্ঠ ওড়ানো হতো না।অন্দরমহলে বিজয়ার প্রস্তুতি চলত তখন। মাটির অসুর তৈরি করে রাজা তীরধনুক দিয়ে অসুরবধ করতেন।
১৭৪৯ সালে ঝাড়গ্রামে চিল্কিগড়ের সামন্তরাজা গোপীনাথ মত্ত গজ সিং স্বপ্নাদেশ পেলেন… রানির হাতের সোনার কঙ্কন দিয়ে দেবী দুর্গার চতুর্ভুজা অশ্বারোহী মূর্তি গড়তে হবে। সে মূর্তি কনকদুর্গা নামে পরিচিত হলো। ওখানে ব্রাহ্মণ ছিল না বলে ওড়িশা থেকে ব্রাহ্মণ রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীকে আনা হয় পুজো করার জন্য। পুরুষানুক্রমে তাঁরাই পুজো করে আসছেন আজও। দেবী এখানে রক্তমুখী। মহাষ্টমীতে নরবলি হতো আগে। একবার ভুল করে এক ব্রাহ্মণপুত্রকে ধরে আনার পর তাকে ব্রাহ্মণ বুঝতে পেরে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন থেকে নরবলি বন্ধ। মানে হল অব্রাহ্মণপুত্র বলি দেবার রীতি ছিল। তারপর থেকে ১০/১২ টি মোষ ও ৫০০-র বেশি ছাগ বলি হয়। সে সব মাংস মহানবমীর ভোগে লাগে। পুজোর সময় রাজবাড়ীর লোকজন ছাড়া মায়ের সমুখে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। পুজো শেষে সবার জন্য মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। প্রজাদের আনন্দ দেবার জন্য যে নাচগানের আসর বসে তাতে রাজা প্রজা একসঙ্গে আনন্দ করেন।
১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা তাঁদের আদি বাসভবনে যে দুর্গাপুজো করেন, তাকে কলকাতার সবচে প্রাচীন দুর্গাপুজো বলে ধরা হয়। বর্তমানে তাঁদের সাত শরিকের সাতটি পুজো হয়। ছ-টি বড়িশায় এবং একটি বিরাটিতে।
১৭৫৭ সালে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব যে পুজো করেছিলেন, সেটি কলকাতার পারিবারিক পুজোর প্রাচীনত্বের দিক থেকে দ্বিতীয়। নবকৃষ্ণ দেব ইংরেজদের তাঁবেদার ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজদের তুষ্ট করতে তিনি দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। ফলে শাস্ত্রাচার এখানে গৌন। ইংরেজ তুষ্টিই প্রধান। লর্ড ক্লাইভ উপস্থিত ছিলেন সে পুজোয়। প্রতিমার সামনে বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজি নাচগান হতো। উইলসন হোটেল থেকে গরু আর শূয়োরের মাংস আনা হতো। প্রচুর মদ্যপান চলত।
নবকৃষ্ণ দেব কাশী থেকে ব্রাহ্মণ এনেছিলেন বেদ, রামায়ণ ও চণ্ডীপাঠ করার জন্য। এক সময় পশুবলি দেয়া হতো। শোনা যায়… একবার এক বলির পশু হিন্দুকুলচূড়ামণি রাধাকান্ত দেবের পায়ের তলায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেই থেকে পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। নানা ভাজাভুজি ও মিষ্টি দিয়ে মায়ের ভোগ হয়। মনে পড়ল বঙ্কিমচন্দ্রকে।… “যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাঁটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।” সে সময় কলকাতা শহরে যে বাবু সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল তাদের উৎসব মানে ইংরেজ তুষ্টি। তার জন্য যা যা করণীয় সবকিছুই তাঁরা করতেন। শাস্ত্রাচার গৌন হয়ে উঠত। তাঁকে অনুসরণ করে সে সময় কলকাতার ধনীসম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপূজা পারিবারিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
এদের পুজোয় এমন অনাচার দেখে জানবাজারের বাড়িতে শুদ্ধাচারে পুজো শুরু করেন রানি রাসমণি। ইংরেজদের বদলে দেশীয় প্রজাদের আনন্দ দিতে তিনি যাত্রার আসর বসাতেন। ১৮৬১ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে পুজো করতে থাকেন।
কালীঘাটে কবে থেকে যে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল জানা যায় না। তবে আলাদা দুর্গামূর্তি আসে না। দেবী কালীকে চামুন্ডাদুর্গা রূপে পুজো করা হয়। মহানবমীতে যে বলি হয় তা পুরোহিত ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায় না। দেখতে দেয়া হয় না। নবমীতে পান্তাভাতের ভোগ হয়। সিঁদুরখেলার সময় পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ।
১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো শুরু করেন। তখন মা সারদা বেঁচেছিলেন। তিনি উপস্থিত থাকতেন পুজোয়। তাঁর নামে সংকল্প হতো। এখনো তাই হয়। পুজোর সূচনা জন্মাষ্টমী থেকেই। ১৯০১ থেকে কুমারী পুজো হয়ে আসছে এখন পর্যন্ত। দর্শনার্থীরা প্রতিদিন ভোগ সেবা করে। বেলুড় মঠসহ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখাকেন্দ্র এবং ভারত সেবাশ্রমেও সন্ন্যাসীরা পুজো করেন। রীতিমতো শাস্ত্রাচার মেনেই সেসব পুজো হয়।
প্রতিবেশী বাংলাদেশের সেরা পুজো হলো বাঘের হাটের শিকদার বাড়ির পুজো। নোয়াখালীর চৌমুহনীর রামেন্দ্র সাহার বাড়ির সামনে ৭১ ফুট দেবীমূর্তি বাংলাদেশের প্রথম সেরা প্রতিমা।
লক্ষ্যণীয় যে এসবই হলো পারিবারিক পুজো। এক সময় পারিবারিক গন্ডী ছাড়িয়ে দুর্গোৎসব বারোয়ারি পুজোর রূপ নেয়। বারো ইয়ারি(বন্ধু) মিলে যে পুজো, সেটাই বারোয়ারি পুজো। এখন বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজোর সংখ্যা বেশি। “বারোয়ারি” শব্দটি পশ্চিম বঙ্গেই প্রচলিত।
এ বিষয়ে অগ্রগামী হলেন হুগলীর গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু। তাঁরা চাঁদা তুলে যে পুজোর সূত্রপাত করলেন লোকমুখে তা হয়ে উঠলো বারোয়ারি পুজো।
এখন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পুজোর সংখ্যা কমে গেছে। বারোয়ারি পুজো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধু পশ্চিম বঙ্গে কেন প্রতিবেশি বাংলাদেশেও বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজো বেশ জনপ্রিয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ১৯১০ সালে বলরামবসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি পুজোর যে আয়োজন হলো, সেটাই কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি পুজো। পরে পরে ১৯১১- তে শ্যামাপুকুর আদি সর্বজনীন, ১৯১৩ -তে শিকদার বাগান,১৯১৯-এ নেবুবাগান, ১৯২৬ -শে সিমলা ব্যায়াম সমিতি ইত্যাদি সর্বজনীন পুজো শুরু হয়ে গেল। তবে কিছু কিছু পারিবারিক পুজো বিশেষত কলকাতার ধনী পরিবারে এখনো চলে আসছে। এগুলো “বনেদি বাড়ির পুজো” নামে বিখ্যাত। টলিউড এবং বলিউডের ফিল্মস্টারদের পারিবারিক পুজো কলকাতায় এবং মুম্বাইতে দেখার মত। টি ভি-তে বার বার দেখানো হয়। পারিবারিক পুজোয় শাস্ত্রাচার মেনে দেবী পূজিতা হন। বারোয়ারি পুজোয় তেমনটি চোখে পড়ে না। মণ্ডপ, আলো আর আড়ম্বরের জমক বড্ড বেশি। আঞ্চলিক স্তরে বারোয়ারি পুজো বেশি হয়।
মনে করা হয় যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই সর্বজনীন পুজো শুরু হয়েছে। মূলত দেবীকে মাথায় রেখে দেশমাতা, ভারতমাতা বা মাতৃভূমির কল্পনা করা হয়েছে সে সময়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকে বঙ্কিমচন্দ্র “বন্দেমাতরম” গানটি রচনা করেছিলেন। গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হয়ে উঠেছিল। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুসহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।
ভারত, বাংলাদেশ,নেপাল, ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে দুর্গাপুজো হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব রূপে পালিত হয়। বিহার,আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, মণিপুর, ওড়িশায় পুজো হয়। প্রবাসী বাঙালিদের পুজো তো রীতিমতো মিলনমেলার রূপ নিয়েছে। কদিন খাওয়াদাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান…সে বেশ জম্পেশ ব্যাপারস্যাপার। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মন্ডপ তৈরি হয়, চমকপ্রদ আলোকসজ্জা হয়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে পাঁচদিন এলাহি জীবনযাত্রা চলে।
এখন সাবেকি পুজোর জায়গা নিয়েছে থিম পুজো। যোগ হয়েছে খুঁটিপুজো। সাবেকি দোচালা বা চারচালার মণ্ডপ দেখা যায় না আর। চালচিত্র থাকে না। “ডাকের সাজ” শব্দটা হয়তো আর শোনাই যাবে না। শোলার কাজ কিছু কিছু দেখা যায় অবশ্য। এক কাঠামোতে মায়ের ছেলেপুলেরা বসেন না আর। সবার জন্য আলাদা আলাদা কাঠামো। হয়তো ঠাকুর নিয়ে আসা আর বিসর্জনের সুবিধা হয়েছে তাতে। থিম অনুযায়ী মণ্ডপ এবং ঠাকুর তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিষয় উঠে আসে থিমে। এক সময় পরিবেশ দূষণ, স্বাক্ষরতা অভিযান, আন্দামানের জারোয়া জীবন, মক পার্লামেন্ট, ফ্লাইং সসার, কন্যাভ্রূণহত্যা, কন্যাশ্রী দেখেছি আমরা। গত বছর, এ বছর হয়তো করোনাসুর দেখতাম। বিধি বাম হলে কী করার আছে! আলোকসজ্জা, লেসার বিম কম আকর্ষণীয় হয় না। অঞ্চলে অঞ্চলে এই বিষয়ে প্রতিযোগিতা দেখার মত। কোটি কোটি টাকার লেনদেন চলে। খেটে খাওয়া কত মানুষের কিছু রোজগার হয় পুজোর সময়।
১৯৮৫ সালে এশিয়ান পেইন্টস “এশিয়ান শারদ সম্মান” পুরস্কার দেয়া শুরু করেন। শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখে পুরস্কার দেয়া হয়। পরে পরে আরো অনেক সংস্থা “শারদ সম্মান” দিতে শুরু করে।
পুজোর কথা বলতে গেলে কুমোরটুলির কথা না বললে বলা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যদিও অল্প কিছু জায়গায় বিক্রির জন্য কিছু কিছু ঠাকুর তৈরি হয়, গ্রামগঞ্জে ঠাকুর তৈরি হয় স্থায়ী চণ্ডীমণ্ডপে। কলকাতা এবং তার আশেপাশে ঠাকুরের জোগানদার কিন্তু কুমোরটুলি। ইউরোপ,আমেরিকা,আফ্রিকার প্রবাসী বাঙালিরা ঠাকুর নিয়ে যায় এখান থেকেই। সুইডেন,অষ্ট্রেলিয়া,মালয়েশিয়া,নাইজেরিয়া প্রভৃতি জায়গায় বিমান যোগে পাড়ি দেন মা। শোলার ঠাকুর, দেশলাই কাঠির ঠাকুর, খুরি-কলকের ঠাকুর, আইসক্রিম কাঠির ঠাকুর, বাঁশের ঠাকুর, থার্মোকলের থালা বাটির ঠাকুর, ছোবড়ার ঠাকুর, তারের ঠাকুর…মূর্তি গড়তে কতকিছুকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে! মনে পড়ে অবন ঠাকুরের কাটুম কুটুমের কথা। নিন্দুকেরা তাতে ভক্তিটক্তি খুঁজে না পেলেও শিল্প হিসেবে সৃজনীশক্তির তুলনা হয় না সেসবের। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা শিল্পীদেরও দেখা যাচ্ছে কুমোরটুলিতে। কত মানুষ যে জড়িত থাকে এই কাজে! থিম পুজোয় ইণ্ডিয়ান আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা তুঙ্গে।
দু বছর আগেও শিয়ালদা স্টেশনে নামলে ঢাকিদের লাইন চোখে পড়ত, ঢাকের আওয়াজে মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠত। গত বছর থেকে সেসব বন্ধ। আমাদের ছোটবেলায় পুজোর বেশ আগে থেকে পুজোর গান বাজত রেডিওতে। ঐসব গানের নাড়িনক্ষত্র নিয়ে বই বেরোত। গীতিকার, সুরকার,গায়কের নামসহ পুরো গান লেখা থাকত। গান মুখস্থ করে আমরা রেডিওর অনুরোধের আসর থেকে শুনে শুনে সুর তুলতাম গলায়। কত পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতো! উল্টোরথ,নবকল্লোলের মলাট দেখতাম কেবল। এদের হাত ধরে আমাদের নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশ। এখনো অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে বিনোদনের জগতে অন্য অনেক কিছু ঢুকে পড়ায় বই পড়া কমে গেছে। ই-ম্যাগাজিনের রমরমা এখন। নতুন বইয়ের গন্ধের সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে কী?
করোনার তৃতীয় ঢেউ দুয়ারে। এ বছরটাও যাবে নিস্ফলা। যে ঢাকী সারা বছর তাকিয়ে থাকত দুটো ধুতি, একটি গেঞ্জি, একটি গামছা, পাঁচটি দিন পেটপুরে খাবার আর ক-টি টাকার জন্য, সে হতাশায় মুহ্যমান। শিল্পীরা স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘরের কোনে। কুমোরটুলিতে অন্ধকার। মরশুমী প্রেম থেমে আছে গত বছর থেকে। এত যন্ত্রণায় কত আর স্মৃতির ঝাঁপি মহাজন হতে পারে!!
রেখা রায়
গত বছর থেকে অতিমারির কারণে বাঙালির সব রকম উৎসবে ভাঁটা পড়েছে। তবু যখন বর্ষাশেষে ঘন নীল আকাশে জল ভারহীন লঘুমেঘের দল ডানা মেলে, রোদ্দুরে সোনা রঙ লাগে, বাতাসে হিমেল পরশ, আঙিনা আলো করে ঝরে পড়ে অজস্র শিউলি। পতিত জমিতে, নদীতীরে, জমির আলে দলে দলে কাশ মাথা দোলায়, দিঘি পুকুর আলো হয়ে থাকে শালুক-পদ্মে, তখন পাটপচানির গন্ধও ভারি মিঠে লাগে। গেরস্থের দুয়ারে দুয়ারে আগমনী গেয়ে চলে গ্রামীন শিল্পী। মা আসছেন। চাই কী আকাশ জুড়ে রামধনুও বড় উজ্জ্বল হয় তখন।
এই সময়েই জগজ্জননী মা দুর্গা ছেলেপুলে নিয়ে বাপের বাড়ি আসেন পাঁচটি দিনের জন্য। আপামর বাঙালি, দরিদ্র বাঙালি, ঘরকুনো বাঙালি, গেরস্থ বাঙালি, মহাজনি দেনার দায়ে আধপেটা খাওয়া জর্জরিত হাড্ডিসার বাঙালি, ভাগচাষী বাঙালির হৃদকমলে ঢেউ জাগে। প্রবাসী বাঙালি ঘরে ফেরে। বেশ অন্যরকম লাগে সময়টা। শতেক দুঃখ দারিদ্রের মধ্যেও চারপাশটা আলো আলো হয়ে ওঠে।
বারোয়ারি তলার চণ্ডীমণ্ডপে কাঠামো বাঁধা শুরু হয়ে গেছে। কাঠামোর গায়ে খড় জড়ানো, মাটি লাগানো হচ্ছে। ঠাকুর একমেটে হলো, দোমেটে হলো। সারি সারি ছাঁচের মুখ আকাশপানে ভাদ্রের রোদ্দুরে শুকোচ্ছে চটের ওপর। ঢাকিপাড়ায় ঢাক ছাইবার তোড়জোড়। বিকেল হলে ঢাকের মহড়া শোনা যাচ্ছে। অমুক জায়গায় যাত্রার আসর বসবে, অমুক জায়গায় পুতুলনাচের বায়না হয়েছে…এসবও কানে আসছে। আমরা ছোটরা স্কুলে আসাযাওয়ার পথে ঠাকুর গড়া দেখছি কিছুটা সময় ধরে। যাত্রা আর পুতুলনাচের খবর পৌঁছে দিচ্ছি বাড়ির অন্দরমহলে। এসব হলো গাঁ গঞ্জের কথা। কিন্তু কলকাতায় বা আমাদের রাজ্যে বা অন্য কোথাও?
হিন্দুপ্রধান কলকাতারও বড় উৎসব তো দুর্গাপুজোই। উত্তর গোলার্ধের রিও কার্নিভ্যাল বলা হয় কলকাতার দুর্গাপুজোকে। পুজোর মাস কয়েক আগে থেকে যে ভিড়ভাড়াট্টা দেখা যেত রাস্তাঘাটে, কেনাকাটার হিড়িক লাগত দোকানে দোকানে ,গত বছরের মত এবছরও তা দেখা যাচ্ছে না এখনো। এই অবস্থায় ঘরে বসে স্মৃতিচারণ করা ছাড়া আর উপায় কী!
অজয় নদীর তীরে বসন্তকালে দুর্গাপুজো করে সুরথ রাজা সম্পত্তি উদ্ধার করলেন, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করলেন তিনি। রামচন্দ্র শরতকালে অকালবোধন করে সীতা উদ্ধার করলেন। বউ পাগল বাঙালি শরতকালকেই বেছে নিল মাতৃ আরাধনার জন্য। অকালবোধনই হয়ে উঠল আমাদের বড় উৎসব।
অকালবোধন কেন? হিন্দু শাস্ত্র অনুসারে শরতকাল হল দেবদেবীদের ঘুমোবার সময়। এ সময় তাঁদের জাগাতে নেই। বিপাকে পড়ে রামচন্দ্রকে অকালবোধন করতে হয়েছিল। অবশ্য বাল্মিকী রচিত মূল রামায়ণে এটি নেই। কেউ কেউ বলেন বৈদিক যজ্ঞের আধুনিক রূপায়ণ হলো অকালবোধন।
জনশ্রুতি আছে রাজশাহীর তাহিরপুরে রাজা কংসনারায়ণ মহা আড়ম্বরের সঙ্গে প্রথম শারদীয় দুর্গাপূজা করেন।
অষ্টাদশ শতাব্দীতে নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মহালয়ার দিন থেকে দুর্গাপূজার প্রচলন করেছিলেন। মহালয়া থেকে যজ্ঞ শুরু হতো তাঁর পুজোয়। যজ্ঞের আগুন নিভতো না ক-দিন। দেবী এখানে যোদ্ধৃবেশে। প্রতিমা তৈরির মাটি মাখা হতো শুধুমাত্র গঙ্গাজল দিয়ে। সেজন্য নবদ্বীপের গঙ্গার ঘাট থেকে গঙ্গাজল আনা হতো। ভাসানে নীলকণ্ঠ পাখি সঙ্গে যেত। ভাসান হয়ে গেলে পাখি ফিরত রাজবাড়ীতে। নীলকণ্ঠ ওড়ানো হতো না।অন্দরমহলে বিজয়ার প্রস্তুতি চলত তখন। মাটির অসুর তৈরি করে রাজা তীরধনুক দিয়ে অসুরবধ করতেন।
১৭৪৯ সালে ঝাড়গ্রামে চিল্কিগড়ের সামন্তরাজা গোপীনাথ মত্ত গজ সিং স্বপ্নাদেশ পেলেন… রানির হাতের সোনার কঙ্কন দিয়ে দেবী দুর্গার চতুর্ভুজা অশ্বারোহী মূর্তি গড়তে হবে। সে মূর্তি কনকদুর্গা নামে পরিচিত হলো। ওখানে ব্রাহ্মণ ছিল না বলে ওড়িশা থেকে ব্রাহ্মণ রামচন্দ্র ষড়ঙ্গীকে আনা হয় পুজো করার জন্য। পুরুষানুক্রমে তাঁরাই পুজো করে আসছেন আজও। দেবী এখানে রক্তমুখী। মহাষ্টমীতে নরবলি হতো আগে। একবার ভুল করে এক ব্রাহ্মণপুত্রকে ধরে আনার পর তাকে ব্রাহ্মণ বুঝতে পেরে ছেড়ে দেয়া হয়। তখন থেকে নরবলি বন্ধ। মানে হল অব্রাহ্মণপুত্র বলি দেবার রীতি ছিল। তারপর থেকে ১০/১২ টি মোষ ও ৫০০-র বেশি ছাগ বলি হয়। সে সব মাংস মহানবমীর ভোগে লাগে। পুজোর সময় রাজবাড়ীর লোকজন ছাড়া মায়ের সমুখে সাধারণের প্রবেশাধিকার নেই। পুজো শেষে সবার জন্য মন্দিরের দ্বার উন্মুক্ত করা হয়। প্রজাদের আনন্দ দেবার জন্য যে নাচগানের আসর বসে তাতে রাজা প্রজা একসঙ্গে আনন্দ করেন।
১৬১০ সালে কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা তাঁদের আদি বাসভবনে যে দুর্গাপুজো করেন, তাকে কলকাতার সবচে প্রাচীন দুর্গাপুজো বলে ধরা হয়। বর্তমানে তাঁদের সাত শরিকের সাতটি পুজো হয়। ছ-টি বড়িশায় এবং একটি বিরাটিতে।
১৭৫৭ সালে শোভাবাজারের রাজা নবকৃষ্ণ দেব যে পুজো করেছিলেন, সেটি কলকাতার পারিবারিক পুজোর প্রাচীনত্বের দিক থেকে দ্বিতীয়। নবকৃষ্ণ দেব ইংরেজদের তাঁবেদার ছিলেন। সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর ইংরেজদের তুষ্ট করতে তিনি দুর্গাপুজোর আয়োজন করেন। ফলে শাস্ত্রাচার এখানে গৌন। ইংরেজ তুষ্টিই প্রধান। লর্ড ক্লাইভ উপস্থিত ছিলেন সে পুজোয়। প্রতিমার সামনে বাইজি নাচের আসর বসত। ইংরেজি নাচগান হতো। উইলসন হোটেল থেকে গরু আর শূয়োরের মাংস আনা হতো। প্রচুর মদ্যপান চলত।
নবকৃষ্ণ দেব কাশী থেকে ব্রাহ্মণ এনেছিলেন বেদ, রামায়ণ ও চণ্ডীপাঠ করার জন্য। এক সময় পশুবলি দেয়া হতো। শোনা যায়… একবার এক বলির পশু হিন্দুকুলচূড়ামণি রাধাকান্ত দেবের পায়ের তলায় আশ্রয় নিয়েছিল। সেই থেকে পশুবলি বন্ধ হয়ে যায়। নানা ভাজাভুজি ও মিষ্টি দিয়ে মায়ের ভোগ হয়। মনে পড়ল বঙ্কিমচন্দ্রকে।… “যিনি উৎসবার্থ দুর্গাপূজা করিবেন, গৃহিণীর অনুরোধে লক্ষ্মীপূজা করিবেন, উপগৃহিণীর অনুরোধে সরস্বতী পূজা করিবেন, এবং পাঁটার লোভে গঙ্গাপূজা করিবেন, তিনিই বাবু।” সে সময় কলকাতা শহরে যে বাবু সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল তাদের উৎসব মানে ইংরেজ তুষ্টি। তার জন্য যা যা করণীয় সবকিছুই তাঁরা করতেন। শাস্ত্রাচার গৌন হয়ে উঠত। তাঁকে অনুসরণ করে সে সময় কলকাতার ধনীসম্প্রদায়ের মধ্যে দুর্গাপূজা পারিবারিক মর্যাদার প্রতীক হয়ে ওঠে।
এদের পুজোয় এমন অনাচার দেখে জানবাজারের বাড়িতে শুদ্ধাচারে পুজো শুরু করেন রানি রাসমণি। ইংরেজদের বদলে দেশীয় প্রজাদের আনন্দ দিতে তিনি যাত্রার আসর বসাতেন। ১৮৬১ সালে তাঁর মৃত্যু হলে তাঁর জামাতাগণ নিজ নিজ বাসভবনে পুজো করতে থাকেন।
কালীঘাটে কবে থেকে যে দুর্গাপুজো শুরু হয়েছিল জানা যায় না। তবে আলাদা দুর্গামূর্তি আসে না। দেবী কালীকে চামুন্ডাদুর্গা রূপে পুজো করা হয়। মহানবমীতে যে বলি হয় তা পুরোহিত ছাড়া অন্য কেউ দেখতে পায় না। দেখতে দেয়া হয় না। নবমীতে পান্তাভাতের ভোগ হয়। সিঁদুরখেলার সময় পুরুষদের প্রবেশ নিষেধ।
১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ বেলুড় মঠে দুর্গাপুজো শুরু করেন। তখন মা সারদা বেঁচেছিলেন। তিনি উপস্থিত থাকতেন পুজোয়। তাঁর নামে সংকল্প হতো। এখনো তাই হয়। পুজোর সূচনা জন্মাষ্টমী থেকেই। ১৯০১ থেকে কুমারী পুজো হয়ে আসছে এখন পর্যন্ত। দর্শনার্থীরা প্রতিদিন ভোগ সেবা করে। বেলুড় মঠসহ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখাকেন্দ্র এবং ভারত সেবাশ্রমেও সন্ন্যাসীরা পুজো করেন। রীতিমতো শাস্ত্রাচার মেনেই সেসব পুজো হয়।
প্রতিবেশী বাংলাদেশের সেরা পুজো হলো বাঘের হাটের শিকদার বাড়ির পুজো। নোয়াখালীর চৌমুহনীর রামেন্দ্র সাহার বাড়ির সামনে ৭১ ফুট দেবীমূর্তি বাংলাদেশের প্রথম সেরা প্রতিমা।
লক্ষ্যণীয় যে এসবই হলো পারিবারিক পুজো। এক সময় পারিবারিক গন্ডী ছাড়িয়ে দুর্গোৎসব বারোয়ারি পুজোর রূপ নেয়। বারো ইয়ারি(বন্ধু) মিলে যে পুজো, সেটাই বারোয়ারি পুজো। এখন বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজোর সংখ্যা বেশি। “বারোয়ারি” শব্দটি পশ্চিম বঙ্গেই প্রচলিত।
এ বিষয়ে অগ্রগামী হলেন হুগলীর গুপ্তিপাড়ার বারোজন ব্রাহ্মণ বন্ধু। তাঁরা চাঁদা তুলে যে পুজোর সূত্রপাত করলেন লোকমুখে তা হয়ে উঠলো বারোয়ারি পুজো।
এখন ব্যক্তিগত বা পারিবারিক পুজোর সংখ্যা কমে গেছে। বারোয়ারি পুজো জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। শুধু পশ্চিম বঙ্গে কেন প্রতিবেশি বাংলাদেশেও বারোয়ারি বা সর্বজনীন পুজো বেশ জনপ্রিয়।
বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ১৯১০ সালে বলরামবসু ঘাট রোডে ভবানীপুর সনাতন ধর্মোৎসাহিনী সভার পক্ষ থেকে বারোয়ারি পুজোর যে আয়োজন হলো, সেটাই কলকাতায় প্রথম বারোয়ারি পুজো। পরে পরে ১৯১১- তে শ্যামাপুকুর আদি সর্বজনীন, ১৯১৩ -তে শিকদার বাগান,১৯১৯-এ নেবুবাগান, ১৯২৬ -শে সিমলা ব্যায়াম সমিতি ইত্যাদি সর্বজনীন পুজো শুরু হয়ে গেল। তবে কিছু কিছু পারিবারিক পুজো বিশেষত কলকাতার ধনী পরিবারে এখনো চলে আসছে। এগুলো “বনেদি বাড়ির পুজো” নামে বিখ্যাত। টলিউড এবং বলিউডের ফিল্মস্টারদের পারিবারিক পুজো কলকাতায় এবং মুম্বাইতে দেখার মত। টি ভি-তে বার বার দেখানো হয়। পারিবারিক পুজোয় শাস্ত্রাচার মেনে দেবী পূজিতা হন। বারোয়ারি পুজোয় তেমনটি চোখে পড়ে না। মণ্ডপ, আলো আর আড়ম্বরের জমক বড্ড বেশি। আঞ্চলিক স্তরে বারোয়ারি পুজো বেশি হয়।
মনে করা হয় যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই সর্বজনীন পুজো শুরু হয়েছে। মূলত দেবীকে মাথায় রেখে দেশমাতা, ভারতমাতা বা মাতৃভূমির কল্পনা করা হয়েছে সে সময়। দেবী দুর্গার ভাবনা থেকে বঙ্কিমচন্দ্র “বন্দেমাতরম” গানটি রচনা করেছিলেন। গানটি স্বাধীনতা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হয়ে উঠেছিল। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুসহ অন্যান্য জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীরা বারোয়ারি পুজোর সঙ্গে যুক্ত থাকতেন।
ভারত, বাংলাদেশ,নেপাল, ভারতীয় উপমহাদেশ ও বিশ্বের একাধিক রাষ্ট্রে দুর্গাপুজো হিন্দুদের ধর্মীয় উৎসব রূপে পালিত হয়। বিহার,আসাম, ত্রিপুরা, ঝাড়খন্ড, মণিপুর, ওড়িশায় পুজো হয়। প্রবাসী বাঙালিদের পুজো তো রীতিমতো মিলনমেলার রূপ নিয়েছে। কদিন খাওয়াদাওয়া, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান…সে বেশ জম্পেশ ব্যাপারস্যাপার। লক্ষ লক্ষ টাকা ব্যয়ে মন্ডপ তৈরি হয়, চমকপ্রদ আলোকসজ্জা হয়, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের চণ্ডীপাঠের মাধ্যমে পাঁচদিন এলাহি জীবনযাত্রা চলে।
এখন সাবেকি পুজোর জায়গা নিয়েছে থিম পুজো। যোগ হয়েছে খুঁটিপুজো। সাবেকি দোচালা বা চারচালার মণ্ডপ দেখা যায় না আর। চালচিত্র থাকে না। “ডাকের সাজ” শব্দটা হয়তো আর শোনাই যাবে না। শোলার কাজ কিছু কিছু দেখা যায় অবশ্য। এক কাঠামোতে মায়ের ছেলেপুলেরা বসেন না আর। সবার জন্য আলাদা আলাদা কাঠামো। হয়তো ঠাকুর নিয়ে আসা আর বিসর্জনের সুবিধা হয়েছে তাতে। থিম অনুযায়ী মণ্ডপ এবং ঠাকুর তৈরি হচ্ছে। সাম্প্রতিক বিষয় উঠে আসে থিমে। এক সময় পরিবেশ দূষণ, স্বাক্ষরতা অভিযান, আন্দামানের জারোয়া জীবন, মক পার্লামেন্ট, ফ্লাইং সসার, কন্যাভ্রূণহত্যা, কন্যাশ্রী দেখেছি আমরা। গত বছর, এ বছর হয়তো করোনাসুর দেখতাম। বিধি বাম হলে কী করার আছে! আলোকসজ্জা, লেসার বিম কম আকর্ষণীয় হয় না। অঞ্চলে অঞ্চলে এই বিষয়ে প্রতিযোগিতা দেখার মত। কোটি কোটি টাকার লেনদেন চলে। খেটে খাওয়া কত মানুষের কিছু রোজগার হয় পুজোর সময়।
১৯৮৫ সালে এশিয়ান পেইন্টস “এশিয়ান শারদ সম্মান” পুরস্কার দেয়া শুরু করেন। শ্রেষ্ঠত্বের নিরিখে পুরস্কার দেয়া হয়। পরে পরে আরো অনেক সংস্থা “শারদ সম্মান” দিতে শুরু করে।
পুজোর কথা বলতে গেলে কুমোরটুলির কথা না বললে বলা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। যদিও অল্প কিছু জায়গায় বিক্রির জন্য কিছু কিছু ঠাকুর তৈরি হয়, গ্রামগঞ্জে ঠাকুর তৈরি হয় স্থায়ী চণ্ডীমণ্ডপে। কলকাতা এবং তার আশেপাশে ঠাকুরের জোগানদার কিন্তু কুমোরটুলি। ইউরোপ,আমেরিকা,আফ্রিকার প্রবাসী বাঙালিরা ঠাকুর নিয়ে যায় এখান থেকেই। সুইডেন,অষ্ট্রেলিয়া,মালয়েশিয়া,নাইজেরিয়া প্রভৃতি জায়গায় বিমান যোগে পাড়ি দেন মা। শোলার ঠাকুর, দেশলাই কাঠির ঠাকুর, খুরি-কলকের ঠাকুর, আইসক্রিম কাঠির ঠাকুর, বাঁশের ঠাকুর, থার্মোকলের থালা বাটির ঠাকুর, ছোবড়ার ঠাকুর, তারের ঠাকুর…মূর্তি গড়তে কতকিছুকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে! মনে পড়ে অবন ঠাকুরের কাটুম কুটুমের কথা। নিন্দুকেরা তাতে ভক্তিটক্তি খুঁজে না পেলেও শিল্প হিসেবে সৃজনীশক্তির তুলনা হয় না সেসবের। পুরুষদের পাশাপাশি মহিলা শিল্পীদেরও দেখা যাচ্ছে কুমোরটুলিতে। কত মানুষ যে জড়িত থাকে এই কাজে! থিম পুজোয় ইণ্ডিয়ান আর্ট কলেজের ছাত্রছাত্রীদের চাহিদা তুঙ্গে।
দু বছর আগেও শিয়ালদা স্টেশনে নামলে ঢাকিদের লাইন চোখে পড়ত, ঢাকের আওয়াজে মনটা খুশি খুশি হয়ে উঠত। গত বছর থেকে সেসব বন্ধ। আমাদের ছোটবেলায় পুজোর বেশ আগে থেকে পুজোর গান বাজত রেডিওতে। ঐসব গানের নাড়িনক্ষত্র নিয়ে বই বেরোত। গীতিকার, সুরকার,গায়কের নামসহ পুরো গান লেখা থাকত। গান মুখস্থ করে আমরা রেডিওর অনুরোধের আসর থেকে শুনে শুনে সুর তুলতাম গলায়। কত পত্রপত্রিকা প্রকাশিত হতো! উল্টোরথ,নবকল্লোলের মলাট দেখতাম কেবল। এদের হাত ধরে আমাদের নিষিদ্ধ জগতে প্রবেশ। এখনো অনেক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তবে বিনোদনের জগতে অন্য অনেক কিছু ঢুকে পড়ায় বই পড়া কমে গেছে। ই-ম্যাগাজিনের রমরমা এখন। নতুন বইয়ের গন্ধের সঙ্গে আর কিছুর তুলনা চলে কী?
করোনার তৃতীয় ঢেউ দুয়ারে। এ বছরটাও যাবে নিস্ফলা। যে ঢাকী সারা বছর তাকিয়ে থাকত দুটো ধুতি, একটি গেঞ্জি, একটি গামছা, পাঁচটি দিন পেটপুরে খাবার আর ক-টি টাকার জন্য, সে হতাশায় মুহ্যমান। শিল্পীরা স্বপ্ন বুকে নিয়ে ঘরের কোনে। কুমোরটুলিতে অন্ধকার। মরশুমী প্রেম থেমে আছে গত বছর থেকে। এত যন্ত্রণায় কত আর স্মৃতির ঝাঁপি মহাজন হতে পারে!!
রেখা রায়
